মিঠি ও মা
-পায়েল সাহু
“জানো মা, দাস পাড়ার ঠাকুরটা খুব সুন্দর হয়েছে, ছবি পিসিরা কাল রাতে দেখে এসেছে। ওরা বলছিলো প্যান্ডেলের কাছে গেলেই অনেকগুলো দৈত্য বেরিয়ে আসছে, কি ভয়ঙ্কর তাদের সাজ, তাদের পেরিয়ে প্যান্ডেলে ঢুকে গেলেই মা দুগ্গার ভয়ে ওরা আর আসবে না,খুব মজার ব্যাপার। চলোনা মা, আজ আমরা দেখে আসি ওই ঠাকুরটা!”
একটানা এতোগুলো কথা মাকে বলে ঠাকুর দেখার আবদার করলো মিঠি, মেয়ের মুখে আগ্রহভরে কথাগুলো শুনে ভালো লাগলেও সারাদিনের আট বাড়ি কাজের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মিঠির মায়ের শরীর আর চলে না, দু’ বাড়ি থেকে ভাত দেয় রোজ, কোনোদিন বাসি রুটি থাকলে সেটাও জোটে তার ভাগ্যে, ওইগুলো কৌটোয় ভরে বাড়ি নিয়ে এসে রাতের খাওয়াটা সেরে নেয় তারা তিনজন। সারাদিন গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকা বর আর মেয়ে নিয়ে তার সংসার, হাজারো অনুরোধ, উপরোধ, ঝগড়া, মারপিট কোনো কিছুই বাকি রাখেনি যাতে মিঠির বাবা দু’ পয়সা উপার্জন করে সংসারের হাল ধরে কিন্তু কোনো কিছুতেই মিঠির বাবাকে রাজি করানো যায়নি।
দূর্গাপুজোয় মেয়েকে নিয়ে যে ঠাকুর দেখতে বেরোবে সেটা উপায় অব্দি নেই কারণ পুজোর কদিন কোনো বাড়ি থেকেই ছুটি দেবে না বলেই দিয়েছে, দরকারে পুজোর পর ছুটি নাও কিন্তু পুজোয় ছুটি নয়, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা শরীরটা যেন জবাব দিয়ে দেয়, এক পা হাঁটারও আর ক্ষমতা থাকে না, কতক্ষণে খেয়ে শোবে সেটাই চিন্তা করে।
মিঠির আবদারের জবাবে কিছু না বলতে পেরে অসহায়ের মতো মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, আট বছরের ছোট্ট মিঠিও মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আচমকাই চুপ করে যায়; মনে মনে ঠিক করে পাশের ঘরের বুলবুলি দিদির সঙ্গে সকাল সকাল ঠাকুরটা দেখে আসবে, মা বাড়ি ফেরার আগেই চলে আসবে তাহলে মা কিছু জানতেও পারবে না।
খুব রোদ উঠেছে আজ, মিঠি আজ দুপুর হতেই বেরিয়ে পড়েছে ঠাকুর দেখতে, বুলবুলিদির সময় হবে না বলে সে একাই বেরিয়ে পড়েছে, সে কি আর ছোটটি আছে, কদিন বাদেই নয়ে পড়বে, সে বেশ বড় হয়ে গেছে। পুজোয় মায়ের কিনে দেওয়া সুন্দর জামাটা পরে সে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়েছে বাড়ি থেকে, বাবার চোখ এড়িয়ে।
প্যান্ডেলের কাছে যেতেই মা’র জন্য মনটা কেমন করে উঠলো মিঠির; একটু যেন একা একাও লাগলো, দুপুর বলেই হয়তো খুব একটা ভিড় নেই, একটু ফাঁকা ফাঁকাই। প্যান্ডেলে ঢোকার মুখটা একটু অন্যরকম, একটু সরু মতো, যথারীতি প্যান্ডেলের ঢোকার একটু আগেই তেড়ে এলো বেশ কিছু দৈত্য, মিঠির একটু আগে যারা ছিলেন তারা তাড়াতাড়ি প্যান্ডেলে ঢুকে গেলেও মিঠি এতোই ভয় পেয়ে গেলো যে প্যান্ডেলে না ঢুকে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় দিলো যে দিকে পারলো, বেশ কিছুক্ষণ এভাবে দৌড়োনোর পর মিঠি নিজেকে আবিষ্কার করলো কোনো এক নির্জন রাস্তায়, যেখানে চারপাশে রকমারি ফুলের গাছ, একটু দূরে সারি দিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছ আর তাতে ফুলের অপূর্ব বাহার। মিঠি চারপাশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভুলে গেলো বাড়ি ফেরার কথা, সে কোচড় ভরে ফুল তুলে নিয়ে, দু’টো আধলা পাথরের টুকরোকে ঠাকুর বানিয়ে পথের ধরেই বসে খেলতে লেগে গেলো।
বিকেলের আলো পড়ে আসতেই এবার মিঠির মায়ের কথা মনে পড়লো, এতক্ষণে চারদিকে তাকিয়ে খেয়াল করলো তার চারপাশটা এতোই নির্জন, যে মানুষ তো দূর একটা কুকুরকেও সে এতক্ষণ দেখতে পায়নি।এবার মিঠি ভয় পেলো বেশ, কোন দিকে এগিয়ে গেলে যে তার বাড়ির পথ পাবে সেটা বুঝে উঠতে পারেনা। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে আগের জায়গায়। কিছু বুঝতে না পেরে মিঠি “মা গো, কোথায় তুমি? বাড়ি নিয়ে যাও গো! ঠাকুর দেখবো না আমি” বলে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে।
সারা বছরে কদিনের জন্য পুজো আসে, মেয়েটা আনন্দ করে বললো ঠাকুর দেখতে যাবে আর সে এমন মা যে মেয়ের এইটুকু আবদারও রাখতে পারেনা।অজান্তেই চোখের কোনা দিয়ে জল বেরিয়ে আসে মিঠির মায়ের, মেয়েটা মায়ের বুকের কাছে জড়ো সড়ো হয়ে ঘুমিয়ে আছে, মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মিঠির মায়ের চোখেও ঘুম নেমে আসে, মিঠির বাবা থেকেও নেই, শুধু মাত্র সারাদিনে একটু হলেও মেয়েকে দেখে রাখবে বলেই মিঠির মা আজও মিঠির বাবাকে ওর ঘরে ঠাঁই দিয়েছে, অবশ্য তার জন্য মিঠির বাবাকে আলাদা কিছু টাকাও দিতে হয়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মিঠির মা স্বপ্ন দেখলো মিঠি অভিমান করে একা একাই ঠাকুর দেখতে গিয়ে হারিয়ে গেছে, কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা তাকে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে মিঠির মায়ের, চিৎকার করে ওঠে সে।
খানিক পরেই মিঠির বাবার জোর ধাক্কায় ঘুম ভেঙে যায় ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকা মা মেয়ের।
“তোদের কি হয়েছে কি মা মেয়ে এরকম ভোর রাতে কাঁদতে শুরু করেছিস! একটু বিশ্রাম নেবো তার উপায় নেই” মিঠির বাবা ভয়ঙ্কর বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে।
কিন্তু মা মেয়ের সেসব কানে যায় না, মিঠি মা’কে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে “মা গো তোমায় না বলে আর কোথাও যাবো না কখনো একা একা, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব ভয় করে” ওদিকে মিঠির মাও বলতে থাকে “তুই কোথায় চলে গেছিলি আমাকে ছেড়ে? আমি কি করে বাঁচবো তোকে ছাড়া? আচ্ছা তুই যা বলবি তাই হবে, পুজো তো সবার, গরীব বড়লোক সকলে আনন্দ করে, আমিও যাবো তোকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে, ভালো মন্দ রান্না করে খাবো।”
মিঠির বাবা এতক্ষণ চুপ করে সব শুনে এবার বলে উঠলো “রাতের বেলা সবাই তো খাওয়া দাওয়া করে শুলাম, তোমরা মা মেয়ে মাঝরাতে উঠে কোথায় গেছিলে, মিঠিই বা কোথায় হারালো? কেউ কোথাও যায় নি, যে যার নিজের জায়গাতেই আছো তোমরা।”
এবার মিঠি আর মিঠির মা হুঁশ ফিরলো, মিঠি যা যা দেখেছে সবটাই যে স্বপ্ন ছিলো সেটা বুঝে এবার ধাতস্থ হয়ে মার গলা জড়িয়ে বলতে লাগলো স্বপ্নে সে কি কি দেখেছে। মেয়ের স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে মিঠির মা’রও বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে সেও এতক্ষণ স্বপ্নই দেখছিলো, স্বপ্নে মিঠি মাকে খুঁজে পাচ্ছিলো না আর সে তার স্বপ্নে মিঠিকে খুঁজে না পেয়ে হাউ মাউ করে কাঁদছিলো। অদ্ভুত ভাবে দু’জনের স্বপ্ন এক হয়ে গেলো কি করে! একেই কি বলে নাড়ির টান? মেয়েকে গভীর ভাবে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মিঠির মা মনে মনে এটাই প্রতিজ্ঞা করলো দরকার হলে এক বাড়ি কাজ কম করবে, তবু এবার থেকে মেয়ে কে সময় দেবে, ওকে নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরতে যাবে, মিঠির মনে যেন কোনো কষ্ট দানা না বাঁধে সেই দিকে খেয়াল রাখবে। জীবনে অভাব অভিযোগ থাকবেই কিন্তু তার প্রতি মেয়ের ভালোবাসায় কোনো খামতি সে সহ্য করতে পারবে না।
বাকি রাতটুকু মা মেয়ে পরিকল্পনা করতে করতেই কাটিয়ে দেয় শুধু এ বছর নয়, প্রতি বছর একটা দিন পুজোয় ছুটি নেবে মিঠির মা আর সবাই মিলে খুব আনন্দ করবে। নতুন দিনের সূর্যটাও যেন নরম ছোঁয়া দিয়ে শান্ত করে তোলে দু’জনের মনকে।